গানের ব্যান্ড ‘মেঘদল’কে নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কের ইশারা সন্ধান

গানের ব্যান্ড ‘মেঘদল’কে নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কের ইশারা সন্ধান

Other

ফরাসী কবি শার্ল বোদলেয়ারের বিখ্যাত কবিতা ÔL’Etranger’ মূল ফরাসী বা এমনকি ইংরেজিতে না হলেও, অনন্য অনুবাদক-কবি-লেখক বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে বাঙ্গালী ও সাহিত্যের ন্যূণতম পাঠকমাত্রেই পড়েছেন।

: Qui aimes-tu le mieux, homme énigmatique, dis ? ton père, ta mère, ta sœur ou ton frère ?
— Je n’ai ni père, ni mère, ni sœur, ni frère.
(বলো আমাকে, রহস্যময় মানুষ, কাকে তুমি সবচেয়ে ভালোবাসো :
তোমার পিতা, মাতা, ভ্রাতা, অথবা ভগ্নীকে ?
পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভগ্নী -- কিছুই নেই আমার)

এরপর প্রশ্নকর্তা এই L’Etranger বা আগন্তককে প্রশ্ন করতেই থাকেন। সে কি তবে তার বন্ধুদের ভালবাসে? না- ঐ শব্দটি সে জানেই না। সৌন্দর্য? ভালবাসা যেত তাঁকে, তবে তিনি দেবী ও অমরা।

অধরাও বটে। কাঞ্চন বা সোনা-দানা? ঈশ^রের মতই সোনা-দানাকে এই রহস্যময় মানুষ ঘৃণা করেন। তাহলে কাকে ভালবাসে সে? এবার উত্তর আসে:

J’aime les nuages… les nuages qui passent… là-bas… là-bas… les merveilleux nuages !
-আমি ভালোবাসি মেঘ. . .চলিষ্ণু মেঘ. . . ঐ উ'চুতে. . . ঐ উ'চুতে. . .আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল !

আরও পড়ুন

আপনার সন্তান,ভাই বা বোন কি মাদ্রাসায় পড়ে?

বাবা ও পরকীয়া প্রেমিকাকে পেটালো দুই মেয়ে

পল্টন চেকপোস্টে বোমা হামলা: সিটিটিসি

স্বল্প খরচে ৪০ হাজার কর্মী নেবে রোমানিয়া

বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড গানের দল ‘মেঘদল‘কে নিয়ে হালে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিতর্কের কারণ সেই ২০০৫ সালে যখন সমগ্র বাংলাদেশের ৬৩টি জেলায় জেএমবি একযোগে বোমা বিষ্ফোরণ করেছিল, তখন ‘মেঘদলেÔর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও গীতিকার শিবু কুমার শীল সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের প্রতীক হিসেবে সনাতন ধর্মের মন্ত্র, ইসলামে প্রতি বছর ক্কাবা শরীফে হজে¦র সময় আল্লাহর কাছে দেখা দিতে আসা সারা পৃথিবীর মুসলিমরা যে প্রার্থনা বাক্য উচ্চারণ করেন ও বৌদ্ধদের প্রার্থনা বাক্য মিশ্রিত একটি গান রচনা করেন।

এই গানটি পনেরো বছরের বেশি সময় ধরে ইউ টিউবে আছে এবং হাজার হাজার মানুষ দেখেছে। তবে, সহসা কেন আজ এই গানটি ধর্মকে অবমাননা বা আরো বিশেষত: ইসলাম ধর্ম অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হলো? হ্যাঁ, বাংলাদেশে গত ১৩-১৫ই অক্টোবর দুর্গা পূজার সময়ে দেশ জুড়ে ঘটে যাওয়া, ন্যাক্কারজনক সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের পর Ôমেঘদল’ টিএসসিতে আয়োজিত ‘সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী‘ একটি গানের কনসার্টে গানটি আবার গায়। আসুন ত দেখি কি আছে এই গানের লিরিকসে?

ওম অখণ্ডমণ্ডলাকারং,ব্যাপ্তং যেন চরাচরম্ 
তত্পদং দর্শিতং যেন, তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ 
লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক

লাব্বাইক লা শারিকা লা ইন্নাল হা’মদা 
ওয়াননি’মাতা লাকা 
ওয়ালমুলক’ লা শারিকা লা 
বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি 
ধর্মং শরণং গচ্ছামি 
সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি 
বল হরি, হরিবোল, 
তীর্থে যাবো বিভেদের মন্ত্রে স্বর্গ পাবো 
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু 
মানুষ কোরবানী মাশাল্লাহ্ ‌
 হালেলুইয়া জেসাস ক্রাইস্ট, 
ধর্মযুদ্ধে ক্রুসেড বেস্ট

ইউ টিউবে এই গানটি এত বছর ধরে হাজার হাজার মানুষ দেখেছেন। সব ধর্মের মানুষই গানটির প্রতি ভালবাসা ব্যক্ত করেছেন। তবে হুট করে আজ কি এমন হলো যে এমনকি ‘ডিজিটাল সিক্যুরিটি এ্যাক্ট‘-ও নয়, একদম খোদ বাংলাদেশ দন্ডবিধির ২৯৫ ক ধারায় এই গানের দলের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে? মামলাটি দায়ের করেছে এডভোকেট ইমরুল হাসান এন্ড এসোসিয়েটস। গত এক বছরে এই ইমরুল হাসান এন্ড এসোসিয়েটস তিনটি ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানার মামলা করেছে। প্রথম মামলাটি দায়ের করা হয়েছে পালা গানের শিল্পী বাউল রীতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে (রীতা নিজেও জন্মসূত্রে মুসলিম), দ্বিতীয় মামলাটি তারা দায়ের করেছে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমানের বিরুদ্ধে এবং সর্বশেষ ব্যান্ড গান গ্রুপ ‘মেঘদলে’র বিরুদ্ধে। উল্লেখ্য যে ইমরুল ও তার পরিবার সরাসারি জামাত-শিবিরের রাজনীতিতে জড়িত ছিল এবং ইমরুল মহানগর ছাত্র শিবিরের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো যে মামলা দায়ের করতে গিয়ে অভিযোগকারী সংস্থা ব্যান্ড দলটির নামও সঠিক ভাবে উচ্চারণ করতে পারেনি। ‘মেঘদল‘কে উল্লেখ করা হয়েছে ‘মেঘদূত‘ নামে। প্রশ্ন হচ্ছে, ইমরুল হাসান এন্ড এসোসিয়েটস একটির পর একটি ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানার মামলা কি তাদের চেম্বারের নাম বাড়াতে করছে নাকি বাংলাদেশে পাকিস্তানের Blasphemy Law- এর মত কোন ভয়ানক কালো আইন তারা জারি করার প্রেক্ষিত সৃষ্টি করছে? ধর্মানুভূতি এমনি এক অনুভূতি যে কোন তথ্য-প্রমাণ ছাড়া হুট করেই গুজবের দানব প্রবল হয়ে ওঠে এবং তার প্রেক্ষিতে রক্তারক্তি, খুনো-খুনি সবই বৈধ হয়ে যায়। যার শেষতম ঘটনাটি ঘটতে দেখা গেল কুমিল্লা এবং কুমিল্লা থেকে সেই কালো আগুনের বিস্তার সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ায়।  

'মেঘদল‘-এর গানের বাণী কি সত্যিই ইসলামের অনুভূতির সাথে সাঙ্ঘর্ষিক? 
সারা পৃথিবীতেই বিশেষত: মুসলিম বিশে^  Ôসূফি জনরা ‘ বলে গানের একটি নিজস্ব ধারা আছে। পাকিস্তানের ‘কোক স্টুডিও’ ত‘ অত্যাধুনিক পশ্চিমা হেভি মেটাল যত সাঙ্গীতিক বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের সাথে সাথে শেখ সাদি থেকে শুরু করে ইসলামের ইতিহাসের নামী সব মরমী কবি, সাধক বা গীতিকারদের গানের আধুনিক ফিউসন ভার্সান বাজারে ছাড়ার জন্য বিখ্যাত। ইউ টিউবে গেলে প্রতিটি ইসলামী মিলাদে শেখ সাদির বিখ্যাত যে ‘বালাগাল উলাবে কামালিহি‘ শিরোনামে ফার্সি গানটি গাওয়া হয়, সেই গানটিই পাকিস্থানের নামী কণ্ঠশিল্পী আবিদা পারভীনের অসামান্য পরিবেশনায় শোনা যেতে পারে।

গানের লিংক: https://www.youtube.com/watch?v=W5xcbgbiZY0

গানটিতে ‘ইয়া মোহাম্মদ‘ যে কত বার বলা হয়েছে সেটা বলার নয়। সুরে সুরে ও হেভি মেটাল বাদ্যযন্ত্রের সাথেই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের কথা বলা হয়েছে। এই উপমহাদেশে যেখানে শাহ আব্দুল করিম রাধার বিচ্ছেদের গান লিখেছেন, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে যেখানে একই সাথে ‘আল্লাহ  ও ‘হরি‘র নামে শত শত বন্দীশ পাওয়া যায়, যেখানে কিনা অসংখ্য মুসলিম ওস্তাদ রাধা-শ্যামের প্রণয়ের বন্দীশ আর হিন্দু সঙ্গীতজ্ঞেরা অনায়াসে আলীর বা খোদার নামে বন্দীশ গান, যেখানে ইউ টিউবে অসংখ্য ইসলামী গান পাওয়া যাবে, সেখানে ‘মেঘদল‘ সত্যিই কি কোন বড় অন্যায় করেছে? সবার আগে তাহলে কবর থেকে খুঁড়ে কাজি নজরুল ইসলামকেই দন্ডবিধি আইনের আওতায় কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাক- শ্যামা সঙ্গীত লেখার অপরাধে! ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিজেও ওপারের অদিতি মুন্সীর গলায় কীর্তনের পাশাপাশি পাকিস্তানের সাবরি ব্রাদার্সের গলায় কাওয়ালী গানের খুব ভক্ত। আমি সঙ্গীত হিসেবে কাওয়ালী জনরারই খুব অনুরাগী। আজো মনে পড়ে যে বেশ কিছু বছর আগেও এক সনাতন ধর্মাবলম্বী গায়ক দূর্দান্ত কাওয়ালি গান করেন বলে এই পোড়ার দেশেই তাঁকে নিয়ে খুব উচ্ছাসের সাথে একটি অনুষ্ঠানে কথা বলছিলেন এক টিভি এ্যাঙ্কর- তা-ও বিটিভির মত রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যমে। একই ভাবে শিবুর এই গানের কথা গত পনেরো বছর এদেশের কোন সংখ্যাগুরুর ধর্মানুভূতিকে আহত করেনি। কিন্ত যেই না ধুয়া উঠেছে, আমি দেখলাম সর্বশেষ টিএসসিতে কুমিল্লা কান্ডের প্রেক্ষিতে ‘মেঘদলে’র এই গানের ইউ টিউব লিঙ্কে খুব রূঢ় কিছু মন্তব্য এসেছে।

ব্যক্তিগত ভাবে শিবু কুমার শীল আমার পরিচিত ত‘ বটেই, তিনি আমার চতুর্থ গল্প গ্রন্থ ‘তিতা মিঞার জঙ্গনামা‘-র জন্য সাদার ওপর নীল রঙে অসাধারণ একটি প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন। এই বইয়ের কাজেই পুরাণো ঢাকায় প্রকাশক ‘বাঙলায়ণে‘র অফিসে যখন যেতাম, তখন প্রকাশক অস্ট্রিক আর্যূ, প্রচ্ছদ শিল্পী শিবু আর আমি মিলে নান-সব্জি খেতে খেতে কত আড্ডা দিয়েছি! শিবুর সাথে শেষ দু‘বার দেখা হয়েছে বোধ করি একবার বেঙ্গল গ্যালারির কাফেতে আর দু‘বছর আগের কোন লিট ফেস্টের সময় বাংলা একাডেমিতে। তথ্যচিত্র নির্মাতা, গায়ক, প্রচ্ছদ শিল্পী শিবুর অনেক গুণ। ভদ্র, সদালাপী ও সজ্জন মানুষ। তবু যখন উগ্রবাদ হু হু করে বেড়েই চলেছে চারপাশে, শিবু ও আমার উভয়ের পরিচিত কোন আন্তরিক মানুষ যখন ফোন করে এই গানে ‘ইসলাম বিদ্বেষ‘ খুঁজে পান, তখন আমিও আতঙ্কিত হয়ে পরশু সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্টে উল্টো শিবুকেই কড়া কথা বলেছি। এটা মনের কথা না। হতাশা ও আতঙ্ক থেকে বলা। যেহেতু উপমহাদেশের সমাজে বহুত্ববাদের অনুশীলন সত্যিই ভয়ানক ভাবে কমে যাচ্ছে, তাহলে ‘আগের দিন‘ আর সত্যিই নেই। শিবুদের এই একই গানের ভার্সানে পনেরো বছর আগেও মানুষের কত সুন্দর সব মন্তব্য আর সাম্প্রতিকতম মঞ্চায়ণের পর সেই গানের ইউ টিউবে কি ভয়ানক সব মন্তব্য! ধর্মকে এদেশে রাজনীতির সাথে জুড়ে সহজ জনপ্রিয়তা অর্জন ১৯৭৫-এর পর থেকে একুশ বছর ধরে চলেছে। কারা করেছে সেটা আমি-আপনি সবাই জানেন। একটা পর্যায়ে রাজনীতিতে টিঁকে থাকতে আওয়ামি লীগকেও সেই খেলায় নামতে হয়েছে। এর ফল দিন দিন দেশটিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমি-আপনি সবাই জানি। এজন্যই বলতে গেলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবার মত নিরাশা থেকে পরশু আমার সামাজিক মাধ্যমের এক পোস্টে আমি উল্টো শিবুদেরই বলেছি যে তারা কেন ‘প্রেক্ষিত‘ বিবেচনা করেননি? একথা সত্য যে পৃথিবীর প্রাচীনতম বিদ্যমান ধর্ম হিন্দু বা সনাতন মতবাদে যেমন একেশ^রবাদ আবার সেই একেশ^রকে তার নানা মহিমার প্রকাশ বোঝাতে অসংখ্য দেব-দেবীর সাকার উপাসনায় বিভক্ত করা থেকে চার্বাকের নিরীশ^রবাদ পর্যন্ত একইসাথে গৃহীত অথবা খ্রিষ্টান ধর্মেও যেমন একেশ^রবাদের কথা বলা হলেও Ôঈশ^র-ঈশ^রপুত্র যিশু খ্রিষ্ট-খ্রিষ্ট মাতা মেরী‘ এবং অনেক সন্তর বিগ্রহ সহ কিছুটা প্রতিকৃতি উপাসনা গৃহীত হয়েছে- ইহুদি ও ইসলাম ধর্ম কঠোরভাবে একেশ^রবাদী। কিন্ত ‘মেঘদলে’ র গানে ব্যবহৃত তিন ধর্মের বানীতেই বরং মজার বিষয় হলো সনাতন ধর্মের যে শ্লোকটি ব্যবহৃত হয়েছে, সেটা একেশ^রবাদের কথা বলছে। বুদ্ধ ত‘ নিরীশ^রবাদীই ছিলেন। আর ইসলাম ধর্মে ক্¦বার সামনে ‘পিলগ্রিমেজ‘-এ আসা সব তীর্থযাত্রীর ‘লাব্বায়িক আল্লাহ’ ধ্বনি উচ্চারণের মাধ্যমে সেই মহান একেশ^রের কাছে আসার বানীই ধ্বনিত হয়েছে।

(মত-ভিন্নমত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv/এমি-জান্নাত